Ad Code

পরমাণু (Atom) আসলে কেমন দেখতে?লিখেছেন -সৌমেন বাগানি

পরমাণু (Atom) আসলে কেমন দেখতে?
লিখেছেন -সৌমেন বাগানি
পরমাণুর কথা বললেই যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে সেটা হোলো স্কুলের পাঠ্য বইতে দেওয়া একটা ছবি - মাঝখানে নিউক্লিয়াস নামে একটা জায়গায় প্রোটন আর নিউট্রন তালগোল পাকিয়ে আছে আর তার চারধারে পাক খাচ্ছে ইলেকট্রন কণারা। অনেকটা আমাদের সৌরজগতের মডেলের মতো যেখানে সূর্যের চারিদিকে গ্রহগুলো পাক খাচ্ছে। সৌরজগতের ক্ষেত্রে গ্রহদের ঘোরার পেছনে যেমন মহাকর্ষ বল ( gravitational force) কাজ করে তেমনই পরমাণুর মধ্যে ইলেক্ট্রন ঘোরার পেছনে কাজ করে তড়িৎ চুম্বকীয় বল ( electromagnetic force)। ১৯১১ সালে পরমাণুর এই প্ল্যানেটরি মডেলেটি প্রকাশ করেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। 

কিন্তু সত্যিই কি পরমাণুর চিত্রটা এরকম? স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের পরমাণু সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য রাদারফোর্ড মডেল দিয়ে কাজ চালানো যেতে পারে কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে আজ জানা গেছে যে পরমাণুর ভিতরটা আদৌ ওরকমটা নয়। 

ইদানিং বেশ কিছুদিন ধরে (প্রায় বছর তিনেক) কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা করছি। রিচার্ড ফাইনম্যান, শ্যন ক্যারল, ব্রায়ান গ্রীন প্রমুখের লেখা পড়ে এবং লেকচার শুনে শুনে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিকতম (এবং বোধ হয় কঠিনতম) এই অদ্ভুত বিষয়টা। স্বয়ং ফাইনম্যানই বলে গেছেন যে পৃথিবীতে কেউই এখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে কি সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। ওনার কথাটা আজও সত্যি, তবে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় আজকের দিনে অনেক ধোঁয়াশা পরিস্কার হয়েছে, সন্দেহ নেই। আমি আমার স্বল্প বুদ্ধিতে যতটুকু আয়ত্ত্ব করতে পেরেছি তার কিছুটা এখানে share করছি পোস্টের শিরোনামের জিজ্ঞাসাটা দিয়ে। ...(Discussions welcome)

জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক এর হাত ধরেই বলা যেতে পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর উদ্ভব। পরমাণুর একেবারে ভিতরের গঠন এব কাজকর্ম কেমন সেটার খোঁজ করাই এই বিষয়ে গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। প্ল্যাঙ্ক, রাদারফোর্ড, নিলস বোরের মত সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা পরমাণুর গঠন এবং চরিত্র সম্পর্কে, নিজ নিজ তত্ব প্রকাশ করেন। ইলেকট্রনের কক্ষপথ ব্যাসার্ধ ( orbital radius) ঠিক কত হবে সেটা বোর অঙ্ক কষে নির্ভুলভাবে বার করে দেন। এতদূর পর্যন্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞানের বোধবুদ্ধি দিয়ে বোঝা সম্ভব ছিলো। এগুলো বুঝতে মগজে খুব একটা চাপ নিতে হোতো না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স তখনও অতটা আজব বিষয় হয়ে ওঠেনি।

বিষয়টা সত্যিই আজব হওয়া শুরু হোলো ১৯২৪ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী লুই ডি ব্রয়ের একটা যুগান্তকারী আবিস্কার দিয়ে। উনি দেখালেন ইলেক্ট্রন শুধুমাত্র একটা কণা নয়, এটা একটা তরঙ্গও। বললেন, সমস্ত ম্যাটারের মধ্যে একইসাথে কণাধর্ম (particle property) এবং তরঙ্গধর্ম (wave property) দুটোই বিদ্যমান। তার মানে, এই মুহূর্তে আপনার হাতে ধরা মোবাইলটা একই সাথে একটা বস্তুপিন্ড (matter) আবার ওটা একটা তরঙ্গও(wave)। 

দাঁড়ান, দাঁড়ান। মাথা ঘোরার এই তো শুরু! এমনি কি বলেছি কোয়ান্টাম মেকানিক্স একটা আজব সাবজেক্ট? ১৯২২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা নীতি ( Uncertainty Principle) প্রকাশ করেন যেটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম প্রধান ভিত বলা চলে। ওনার তত্ব অনুযায়ী কোনো কণার অবস্থান ( position) এবং ভরবেগ ( momentum ) একই সাথে সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। Position যতটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে,গতিবেগ ( velocity) এবং ভরবেগ ততটাই অনিশ্চিত ( uncertain) হয়ে যাবে এবং উল্টোটাও সত্যি। 

কিন্তু এটা কি'করে সম্ভব? আপনি তো দিব্যি দেখছেন আপনার হাতের মোবাইলটা ঠিক আপনার হাতের তালুতেই আছে এবং সেটা স্থির আছে। তার মানে তো আপনি আপনার মোবাইলটার position এবং velocity দুটোই নির্দিষ্টভাবে বলে দিতে পারলেন। কোনো uncertainty নেই তো এখানে! তাহলে কি হাইজেনবার্গ ভুলভাল বলেছেন? আজ্ঞে না। একটা আস্ত মোবাইল আর একটা ছোট্ট কণার ভরের বিশাল পার্থক্যের জন্যই দুটোর ক্ষেত্রে uncertaintyরও বিশাল ফারাক। বস্তু যত বড় হবে এই uncertainty তত কম হবে। Uncertainty আপনার মোবাইল এর ক্ষেত্রেও আছে কিন্তু সেটা অতি নগন্য। কিন্তু উপ পারমাণবিক স্তরে ( sub atomic level) এ সেটার গুরুত্ব অনেক। সমীকরণ আকারে এটাকে লেখা যায়-- 
♡x . ♡p >= h/4pi [ ♡x: uncertainty in location, ♡p: uncertainty in momentum, h: Planck's constant]

কণার তরঙ্গধর্ম আছে সেটা না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু সেটা কেন আছে, বা সেই তরঙ্গের আচরণ - বিচরণ -প্রকৃতি কেমন?
 খুবই জটিল বিষয়, এটা জানতে গেলে তরঙ্গ ক্রিয়া ( wave function )এবং সে সম্পর্কিত কিছু সমীকরণ ( equation) বুঝতে হবে যার জন্য গণিতে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। প্রায় একই সময়ে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার এই wave এর বৈশিষ্ট্য একটা equation দ্বারা ব্যাখ্যা করেন যেটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ equation। শ্রোডিঙ্গার এর জন্য নোবেল পান 1933 সালে।
এটা খুবই জটিল একটা গাণিতিক সমীকরণ (linear partial differential equation) যার মোদ্দা কথাটা আমি বুঝেছি, কিন্তু equation এর derivation টা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আয়ত্ত্ব করার। যাইহোক, এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া এখানে সম্ভব নয়।

অনেকে হয়তো ভাবছেন যে atom বা পরমাণু আসলে কেমন দেখতে সেটা বলতে গিয়ে আমি এতো সব গম্ভীর গম্ভীর কথাবার্তা কেন হেঁজিয়ে যাচ্ছি! যাচ্ছি এই কারণেই যে, পরমাণুর ভিতরের আসল চিত্রটা wave function এবং শ্রোডিঙ্গার equation এর দ্বারাই বোঝা সম্ভব। আর সে চিত্রটা রাদারফোর্ড মডেলের মতো অত সোজাসাপটা আদৌ নয়।

তো, কি ব্যাখ্যা দেয় wave function? বহু পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে ইলেক্ট্রন বা প্রোটন কোনো বিশেষ সময়ে বিশেষ স্থানে সুনির্দিষ্ট ভাবে মোটেও অবস্থান করে না। তরঙ্গধর্ম (wave property) বজায় রাখতে গিয়ে কণাগুলো একই সময়ে সব জায়গায় থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভাষায় যাকে বলা হয় সুপারপজিশন ( superposition)। নিউক্লিয়াসের চারদিকে সর্বত্র ইলেকট্রনের একটা মেঘ থাকে গোটা নিউক্লিয়াসটাকে ঘিরে। বা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে ইলেকট্রনের "থাকার সম্ভাবনার (probability)" একটা মেঘ নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকে। 

সম্ভাবনার মেঘ? কেমন উদ্ভট শোনাচ্ছে, তাই না? তা শোনালেও কথাটা ১০০% সত্যি। পুরো কোয়ান্টাম মেকানিক্স সাবজেক্টটাই সম্ভাবনা বা probability র ওপর ভিত্তি ( base )করেই দাঁড়িয়ে আছে। তবুও ভাবতে অবাক লাগে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকেই পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবথেকে সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ ( precise snd accurate) শাখা বলে মনে করা হয়।

 ২০১৩ সালে বিশেষ পদ্ধতিতে হাইড্রোজেন পরমাণুর একটা চিত্র ( image) তৈরি করা হয় যাতে দেখা যায় যে সে ছবি কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা হাইড্রোজেন পরমাণুর ছবির সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ওই ছবিতে রাদারফোর্ড মডেলের মত নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রনের মধ্যে অত ফাঁকা জায়গা নেই, বরং পুরো পরমাণু জুড়ে একটা ত্রিমাত্রিক "ইলেকট্রনের থাকার সম্ভাবনা" ভরে রয়েছে। অবাক লাগলেও মহাবিশ্ব এবং প্রকৃতি এমনটাই। 

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমস্ত তত্ব, অঙ্ক, equation আমাদের সাধারণ জ্ঞান, বোধ- বুদ্ধি,স্বতঃলব্ধজ্ঞান (intuition) কে ধাক্কা দেয়। মহাবিশ্বের যে ছবি বা ধারণা আমাদের মস্তিষ্কের বোধ বুদ্ধির সাথে খাপ খায় আসলে প্রকৃতি অনেকাংশেই সেরকম নাও হতে পারে। সুবিশাল মহাবিশ্বের একটা পুঁচকে গ্রহের একটা তুচ্ছ প্রাণী মানুষের বুদ্ধিতে কুলোলো কি কুলোলো না প্রকৃতির তাতে বয়েই গেলো! প্রকৃতির কোনো বাধ্যবাধকতা ( obligation ) নেই তার নিয়মকানুন মানুষের বোধগম্য করে বানানোর। মানুষ তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রহস্য উন্মোচন করার। সে জন্যই তো আমরা মানুষ।

Post a Comment

0 Comments