বাংলা ভাষার যুক্তবর্ণের জটিলতা সর্বমহলে আলোচিত দীর্ঘ কালব্যাপী। সবাই এ বিষয়েও একমত যে, ভাষার দায় নেই ব্যাকরণমাফিক চলার। বরং, ভাষার অব্যাহত বদলের স্বভাব অনুসারে ব্যাকরণকেই সমসাময়িক হতে হবে। তার ওপর, বাংলা ভাষা সংস্কৃতজাত, নাকি প্রাকৃতজাত, তাও আজ পর্যন্ত পরিস্কার নয়। এটুকু বোঝা যায় যে, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর কিংবা রবীন্দ্রনাথ কারও প্রস্তাবই বাংলাভাষী জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠা পায়নি।
এই প্রেক্ষাপটে এখানে 'ক্ষ' সম্পর্কিত বহু দিনের দুটি প্রশ্ন আলোচনা করতে চাই। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের সর্বশেষ সংস্করণে এই যুক্তাক্ষর সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, "ক ও ষ বর্ণ দুটির যুক্তরূপ। এর উচ্চারণ 'খিয়ো' হলেও শব্দের মধ্যে এর উচ্চারণ দুই রকম, যথা- (১) শব্দের আদিতে খ-রূপে (ক্ষমা, ক্ষয়, ক্ষীণ); এবং (২) অনাদিতে সাধারণত 'ক্খ' ক্বচিৎ 'খ্খ' রূপে (রুক্ষ, লক্ষণ)। বর্ণটিকে ক-বর্ণের অন্তর্ভুক্ত করে অভিধানে স্থান দেওয়া হয়েছে।" ভাষার ক্ষেত্রে মানুষের ব্যবহারিক কথাতে যা প্রতিষ্ঠা পায়, ব্যাকরণ ও অভিধানের পক্ষে তাকে অন্তর্ভুক্ত করাটাই সঙ্গত কাজ। এর পূর্বে বাংলাদেশে প্রকাশিত উচ্চারণ অভিধানগুলোতে বর্ণটির উচ্চারণ সম্পর্কে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। ড. স্বরচিষ সরকার জানান, বেশিরভাগ মানুষ শতবর্ষব্যাপী 'ক্ষ'কে 'খিয়ো' নামে চেনে। তিনি আরও বলেন, পালিতে একে 'যুক্ত-খ' বলা হতো। এখনও, কোথাও কোথাও 'যুক্ত-খ' বলার চল উঠে যায়নি। ক্ষ-এর উচ্চারণ শুধু নয়, ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের সাম্প্রতিক সংস্করণে প্রথমবারের মতো শব্দের অর্থের পাশাপাশি উচ্চারণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দুটি দিক উল্লেখযোগ্য। এক. 'ক্ষ' ছাড়া অপর কোনো যুক্তবর্ণকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আলাদা নামকরণ করার নজির নেই। জ্ঞ, ঞ্জ, হ্ম ইত্যাদি যুক্তবর্ণের ছবি ক্ষ-এর ছবির মতোই জটিল হলেও মানুষ সেগুলোকে কোনো না কোনোভাবে বুঝে নিয়েছে জ+ঞ, ঞ+জ, হ+ম ইত্যাদি হিসেবে। কিন্তু 'ক্ষ'কে নিতে পারেনি আপামর বাঙালি মনস্তত্ত্ব। এটিকে শিশুরা আজও 'যুক্ত-খ' বা মুখে মুখে প্রচলিত হওয়া 'খিয়ো' নামেই চিনতে শিখছে। অর্থাৎ, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই যুক্তবর্ণের বিশেষ 'একক' মূল্য আছে। দুই. ভাষার একেকটি শব্দের উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বানান ও উচ্চারণের হেরফের অবশ্য সব ভাষাতেই মেলে; বাংলাতেও ব্যতিক্রম নেই। তা সত্ত্বেও, ভাষার আসল সৌন্দর্যের উৎস 'কথ্যভাষা' অনুসারেই লিপির হালনাগাদ রূপ প্রত্যাশিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উচ্চারণানুগ বানানের পক্ষপাতী ছিলেন।অনেক তৎসম শব্দ লিখতে 'খিয়ো' আবশ্যক। কিন্তু শুদ্ধবাদীরা কঠোরভাবে বলে দিচ্ছেন, এটিকে ক-এ-ষ বা ক যুক্ত ষ বলতে হবে। ফেসবুকে আমার এক মন্তব্যের জবাবে কলকাতার কবি অনীত রায় লিখেছেন, 'ক্ষ'কে যারা 'খিয়ো' বলে তারা নির্ভুলভাবে ভুল বলে! এর মানে হলো, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ম্ফূর্ত চিহ্নায়নকে ভুল হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে, এভাবেও তো ভাবা যায় যে, উৎস যাই হোক; শব্দ, অক্ষর, বর্ণ ইত্যাদির বর্তমান রূপ, প্রয়োগ, সর্বজনবোধ্য অর্থই তার পরিচয়ের মাপকাঠি। মায়ের পরিচয়েই যে সন্তানকে পরিচিত হতে হয়, তা তো চিরায়ত নয়; সন্তানের পরিচয়েও পিতা-মাতার পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সংস্কৃত উচ্চারণ মেনে 'খিয়ো'কে চিনতে হবে, বাংলা উচ্চারণে চেনার চেষ্টা করা যাবে না, তেমন বিধি প্রতিষ্ঠার যুক্তি তো একমাত্র মতামত নয়। কিন্তু ভাষার ঐক্য বলে একটি বিষয় আছে। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ যতীন সরকার জানিয়েছেন, 'খিয়ো' মুখে মুখে বলা হয়। এর কোনো স্বীকৃতি নেই। এটি ক এবং ষ যুক্তবর্ণ। একে বাদ দেওয়ার চেষ্টা নতুন নয়, পাকিস্তান আমলে গোলাম মোস্তফারা এরকম বেশ কিছু জবরদস্তিমূলক পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, আমরা তা প্রতিহত করেছি। তিনি আরও মতামত ব্যক্ত করেন যে, প্রযোজ্য তৎসম শব্দের বানানে 'ক্ষ' রাখতে হবে ঐতিহ্য সুরক্ষার প্রয়োজনেই। ঐতিহ্য অস্বীকার করলে নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তবে তিনি মনে করেন, বাদ না দিয়েও একে নিয়ে আলাদা করে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
বাস্তব জীবনে, ক+ষ উচ্চারণ বাংলায় নেই। অক্ষর শব্দটিকে আমরা কোনোভাবেই অক্+ষর উচ্চারণ করি না। বলি অক্খর। 'ক্ষমতা'কে বলি 'খমতা'। উচ্চারণানুগ ব্যাখ্যায় দেখা যাচ্ছে, শব্দের প্রারম্ভে এর উচ্চারণ খ এবং মধ্যে ও অন্তে ক্খ এবং কালেভদ্রে খ্খ। স্বভাবতই, এই জটিল এবং উচ্চারণের দিক থেকে প্রায় অচেনা 'ক্ষ' না হলেও বাংলা চলতে পারে নিশ্চয়। কিন্তু লিখিত শব্দ, তথা লিপি ইত্যাদি ছবিও তো বটে। দৃশ্য। ফলে শব্দের, বর্ণের, অক্ষরের নন্দন রক্ষা করার দায় রয়েছে। সামান্য 'গোরু' বা 'ইদ' গ্রহণ করা যেহেতু বাঙালির পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, অতএব, 'ক্ষমা'র স্থলে 'খমা', 'পরীক্ষা'র বদলে 'পরীক্খা' ইত্যাদিও চোখে সইবে না। অধিকন্তু, প্রায় ২১৬টি যুক্তবর্ণের মধ্যে একমাত্র 'ক্ষ' ছাড়া অন্য আর একটিও যুক্তবর্ণের আলাদা ডাকনাম নেই। ফলে, অনেকেই স্বীকার করেছেন, 'ক্ষ' নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার অবকাশ আছে। ভাষাতাত্ত্বিক বেগম জাহান আরা স্পষ্ট দাবি তুলেছেন, 'ক্ষ'কে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি 'ঋ' সম্পর্কেও বলেছেন, বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে 'ঋ'কে স্বরবর্ণের মধ্যে নেওয়ার কারণ নেই। 'ঋ' আসলে ব্যঞ্জনবর্ণ।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যোগাযোগের সময় যেসব শব্দ ব্যবহার করি তা তৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ইত্যাদি শ্রেণি বিবেচনার ঊর্ধ্বেই করি। কোনোটিরই উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি না জেনেই দিব্যি ভাষার মধ্যে বেঁচে থাকি। ভাষা ব্যবহারের ওপর কড়া শাসন চলেও না। মানুষের অমূল্য সম্পদ ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয় তখনই যখন ভাষাভাষীদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়। ১৯৫২ সাল সাক্ষী। ভাষাকে ব্যাকরণে যতই বাঁধো না কেন, সে তার নিজস্ব তরিকাতেই বোল হয়ে ফুটবে। কালে কালে স্থানে স্থানে একই ভাষার রকমফেরও স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা। ব্যাকরণবিদ বলুন, অভিধান প্রণেতা বলুন, ভাষার এই রকমফের এবং পরিবর্তন তারা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মি লিপি থেকে বাংলা লিপির বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ফন্টের সুবিধা-অসুবিধার ভিত্তিতে বা বর্ণের নন্দনের সাপেক্ষে এগুলোর চেহারা বদলের প্রমাণ বাংলা ভাষার ইতিহাসে আছে। প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগের হস্তলিখিত বাংলা পাণ্ডুলিপিগুলো পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। বেশিরভাগ সভ্য জাতির ভাষার অভিধান নিয়মিতভাবে হালনাগাদ হয়, ব্যাকরণ ইত্যাদি সমসাময়িক হয়ে ওঠে। কেবল বাংলার ক্ষেত্রেই তেমনটা হতে দেখা যায় না। এ নেহাত দৈন্য আমাদের।
আমার প্রথম প্রস্তাব- 'ক্ষ'কে যদি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আবশ্যক জ্ঞান করা হয়, তাহলে তাকে বিশেষ একক বর্ণের স্বীকৃতি দিলে কী কী ক্ষয়ক্ষতি হবে, ভাষাতাত্ত্বিকরা তা জনগণের বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করুন। দ্বিতীয় প্রস্তাব- 'ক্ষ'কে আলাদা মর্যাদা না দিতে পারলে, এই যুক্তবর্ণের স্থলে খ, ক্খ, খ্খ ব্যবহার করলে কী কী বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে তার স্পষ্ট কিছু উদাহরণ ভাষাতাত্ত্বিকরা পেশ করুন। বাংলা ভাষার স্বতঃস্ম্ফূর্ততা বিকাশে একাডেমিশিয়ানদের দায়-দায়িত্ব কিছু আছে নিশ্চয়। রাষ্ট্রেরও দায় আছে ভাষা সম্পর্কিত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি থেকে জাতিকে মুক্ত করার।
গল্পকার, অনুবাদক
0 Comments